ডাইনিং রুম সাজানোর আইডিয়া
ডাইনিং রুম সাজানো শুধু সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্যই নয়, বরং এটি পারিবারিক বন্ধন মজবুত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও সংস্কৃতি বিবেচনায় নিয়ে সঠিক আসবাব, রঙ এবং সাজসজ্জা নির্বাচন করলে আপনার ডাইনিং রুম হয়ে উঠবে আরামদায়ক ও আকর্ষণীয়। আজকে আমি জানাবো বিভিন্ন ধরনের বাজেট অনুযায়ী কীভাবে আপনার ডাইনিং এরিয়াকে শিল্পসম্মত, ফাংশনাল এবং আধুনিক করে সাজাতে পারেন।
বাজেট অনুযায়ী সাজানোর পরিকল্পনা
বাজেট কম হোক বা বেশি সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে যেকোনো ডাইনিং স্পেসকেই আকর্ষণীয় করে তোলা সম্ভব। চলুন দেখে নেই কীভাবে বিভিন্ন বাজেট অনুযায়ী সাজানোর পরিকল্পনা করা যায়।
স্বল্প বাজেটে সাজানোর টিপস
যখন বাজেট সীমিত তখন সৃজনশীলতা আপনার সবচেয়ে বড় সহায়ক হতে পারে। পুরোনো আসবাবপত্রকে নতুন রূপে সাজিয়ে তুলতে পারেন সহজেই। যেমন, পুরানো কাঠের চেয়ার-টেবিলকে নতুন রং দিয়ে পেইন্ট করে তাতে নতুনত্ব আনা যায়। মেহগনি বা শেগুন কাঠের টেবিল টেকসই হয় এবং সহজে পরিষ্কারও করা যায়। স্থানীয় বাজার থেকে কম দামে সুন্দর টেবিল ম্যাট, প্লেসম্যাট কিনে ব্যবহার করতে পারেন।
DIY আইডিয়া হিসেবে বাড়িতেই তৈরি করতে পারেন টেবিল রানার, রঙিন কুশন কভার যা ডাইনিং চেয়ারগুলিকে নতুন লুক দেবে। লোকাল মার্কেট থেকে সস্তায় পাওয়া জুট বা ফ্যাব্রিক ব্যবহার করে টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখতে পারেন হ্যান্ডমেড টেবিল ডেকোরেশন।
“কম বেশি যখন বেশি ভালো হয় না” – এই কথাটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। কম বাজেটে সাজানোর সময় আসবাবের সংখ্যা ন্যূনতম রাখুন। অতিরিক্ত আসবাবপত্র ঘরকে চেপে ধরে রাখে। বরং এমন আসবাব ব্যবহার করুন যা একাধিক কাজে আসতে পারে।
মাঝারি ও উচ্চ বাজেটের সাজসজ্জা
বাজেট যদি একটু বেশি থাকে, তাহলে ব্র্যান্ডেড লাইট, মানসম্পন্ন টেবিল সেট বা ডিজাইনার আসবাব কিনতে পারেন। ডাইনিং টেবিলে গ্লাস টপ দেওয়া যেতে পারে, যা টেবিলকে আধুনিক লুক দেয় এবং সহজে পরিষ্কারও করা যায়1। কাঠ ও মার্বেলের কম্বিনেশন সাজসজ্জায় একটি এলিগ্যান্ট টাচ যোগ করবে।
মাঝারি বাজেটের জন্য, আপনি সামর্থ্য অনুযায়ী এক্সটেনডেবল টেবিল বেছে নিতে পারেন, যা নিয়মিত মেহমান আসলে অতিরিক্ত সীট সংযোজনের সুবিধা দেয়। উচ্চ বাজেটে, কাস্টম মেড ডাইনিং সেট, স্মার্ট লাইটিং সিস্টেম, ডিজাইনার ওয়াল আর্ট ইত্যাদি যোগ করে ঘরকে আরও আকর্ষণীয় ও ব্যতিক্রমী করে তোলা সম্ভব।
ছোট ডাইনিং রুম সাজানোর আইডিয়া
অনেক বাড়িতেই ডাইনিং স্পেস সীমিত। তাই ছোট স্পেসে কীভাবে সুন্দর ও কার্যকরী ডাইনিং এরিয়া তৈরি করা যায় তা জানা গুরুত্বপূর্ণ।
স্পেস সেভিং ফার্নিচার ব্যবহার করা এক্ষেত্রে অতীব জরুরী। ভাঁজযোগ্য টেবিল বা ওয়াল মাউন্টেড ডাইনিং টেবিল ব্যবহার করা যেতে পারে, যা প্রয়োজনমতো খুলে বা ভেঙে রাখা যায়। একক বা সিঙ্গেল সাইজের ফার্নিচার ব্যবহার করা ঘর চেপে দেওয়ার পরিবর্তে জায়গা বাঁচায়। যদি প্রয়োজন হয়, ড্র-আউট বিকল্পযুক্ত ফার্নিচার বেছে নিন যাতে অতিরিক্ত দর্শক আসলে ব্যবহার করা যায়।
দেয়াল ব্যবহার করেও জায়গা বাঁচানো যায়। ডাইনিং এরিয়ার দেয়ালে শেলফ লাগিয়ে অতিরিক্ত প্লেট-গ্লাস রাখার ক্যাবিনেট বা বাটি-প্লেট রাখার র্যাক স্থাপন করতে পারেন। বড় মিরর লাগালে ঘর আরও বড় দেখাবে এবং প্রতিফলনের মাধ্যমে আলো বাড়বে।
ওপেন কিচেন ও ডাইনিং কম্বাইন করার মাধ্যমে স্পেস আরও ভালোভাবে ব্যবহার করা যায়। এক্ষেত্রে কিচেন আইল্যান্ডকে ডাইনিং টেবিল হিসেবেও ব্যবহার করতে পারেন, যা স্পেস সাশ্রয় করবে।
ডাইনিং রুমের আলো ও লাইটিং ডিজাইন
আলোর সঠিক ব্যবহার ডাইনিং এরিয়াকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। প্রাকৃতিক আলো ও কৃত্রিম আলোর সঠিক সমন্বয় একটি সফল ডাইনিং রুমের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রাকৃতিক আলোর জন্য, বড় জানালা বা গ্লাস ডোর ব্যবহার করতে পারেন। হালকা পর্দা ব্যবহার করে দিনের বেলায় প্রাকৃতিক আলোকে অবাধে প্রবেশ করতে দিন। কৃত্রিম আলোর ক্ষেত্রে, টেবিলের ঠিক উপরে পেন্ডেন্ট লাইট বা ছোট চ্যান্ডেলিয়ার ব্যবহার করা যেতে পারে। এসব লাইট ডাইনিং টেবিলে ফোকাস করবে এবং খাবার সময় সুন্দর মুড তৈরি করবে।
ওয়াল লাইট, LED স্ট্রিপ বা রিসেস লাইটিং ব্যবহার করে ঘরের বিভিন্ন কোণে আলোর ব্যবস্থা করতে পারেন। ডিম করার সুবিধাযুক্ত লাইট ব্যবহার করলে, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আলোর তীব্রতা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
রঙ ও থিম নির্বাচন
ডাইনিং রুমের রঙ এবং থিম নির্বাচন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি ঘরের মুড নির্ধারণ করে।
হালকা রঙ যেমন সাদা, হালকা বেজ বা পাস্টেল শেড ব্যবহার করলে ঘর বড় ও আলোকিত দেখায়। বিশেষ করে ছোট ডাইনিং রুমের জন্য এই রঙগুলি উপযুক্ত। একরঙা চেহারা যোগ করলে ঘরটি সম্পূর্ণ এবং আকর্ষণীয় দেখায়। এমনকি শুধুমাত্র একটি বিছানা ও দুটি পাশের টেবিলের মতো সহজ আসবাবেও একরঙা ডিজাইন ভিজ্যুয়াল বিভ্রম তৈরি করে যাতে স্পেসটি বড় মনে হয়।
রঙ যেমন নেভি ব্লু, ডার্ক গ্রিন বা বারগান্ডি ব্যবহার করলে ঘরে একটি এলিগ্যান্ট লুক আসে। তবে এই রঙগুলি বড় ঘরের জন্য বেশি উপযুক্ত।
থিমের ক্ষেত্রে, বিভিন্ন থিম বেছে নিতে পারেন যেমন:
- মিনিমাল: সহজ রেখা, কম ডেকোরেশন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন লুক
- রেট্রো: পুরনো আমলের ডিজাইন, ভিনটেজ লাইটিং, ক্লাসিক প্যাটার্ন
- মডার্ন: স্লিক ডিজাইন, মেটাল ও গ্লাসের ব্যবহার
- স্ক্যান্ডিনেভিয়ান: হালকা কাঠ, সাদা রঙ, প্রাকৃতিক উপাদান
ফার্নিচার ও লে-আউট সাজানো
ডাইনিং রুমের কেন্দ্রবিন্দু হল টেবিল ও চেয়ার সেট। টেবিলের ধরন নির্বাচন করার সময় পরিবারের সদস্য সংখ্যা অনুযায়ী সাইজ বাছুন।
টেবিলের আকৃতি ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে:
- গোল টেবিল: সবাইকে মুখোমুখি দেখার সুবিধা, ছোট স্পেসে উপযুক্ত
- আয়তাকার/স্কয়ার টেবিল: বেশি লোকজন বসাতে সুবিধা
- এক্সটেন্ডেবল টেবিল: প্রয়োজনমতো বড় বা ছোট করা যায়, নিয়মিত মেহমান আসলে এটি উপযুক্ত1
চেয়ার বাছাইয়ের সময়, কাঠের চেয়ার বেশি টেকসই হলেও, কুশন চেয়ার আরামদায়ক। সহজে সরানো যায় এমন হালকা চেয়ার নির্বাচন করুন এবং অতিরিক্ত ২-৩টি চেয়ার রিজার্ভ রাখুন। চেয়ারের কুশন ও কভার বাছাই করার সময় টেবিলের রঙ ও ডিজাইনের সাথে মানানসই হওয়া উচিত।
কার্পেট বা রাগসের ব্যবহার ডাইনিং এরিয়াকে আলাদা করে চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। টেবিলের আকারের চেয়ে বড় একটি রাগ বেছে নিন, যাতে চেয়ার টেনে বসার সময়ও রাগের উপরেই থাকে।
টেবিল ডেকর
টেবিল ডেকোরেশন ডাইনিং এরিয়ার সৌন্দর্য বাড়াতে সাহায্য করে। সাধারণ টেবিল ডেকোরেশন আইটেম হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন:
- ফুলদানি: টাটকা বা কৃত্রিম ফুল দিয়ে সাজানো
- ক্যান্ডেল স্ট্যান্ড: সন্ধ্যায় রোমান্টিক মুড তৈরি করতে
- রানার ও প্লেসম্যাট: টেবিলকে আকর্ষণীয় করতে এবং গরম বাসনপত্র থেকে টেবিল রক্ষা করতে
- নেপকিন ও নেপকিন হোল্ডার: এলিগ্যান্ট লুকের জন্য
দেয়াল ও কোণের সাজ
দেয়াল সাজানোর জন্য বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করা যেতে পারে:
- ওয়াল আর্ট, পেইন্টিং বা ফটো ফ্রেম
- ডেকোরেটিভ ঘড়ি
- ম্যাক্রামে বা হ্যান্ডক্রাফট
- বাটি-প্লেট রাখার র্যাক বা ডিসপ্লে শেলফ
ডাইনিং রুমের কোণে ইনডোর গাছ বা প্ল্যান্ট কর্নার তৈরি করে ঘরে প্রাণবন্ত ভাব আনতে পারেন। সার্ভিং ট্রলি বা সাইড টেবিল ব্যবহার করে খাবার পরিবেশনের কাজ সহজ করা যায়।
প্রয়োজন অনুযায়ী কাস্টমাইজেশন
পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের প্রয়োজন অনুযায়ী ডাইনিং এরিয়া কাস্টমাইজ করতে হবে।
যদি বাচ্চারা থাকে, তাহলে:
- ধারালো কোণা বিহীন ফার্নিচার বাছুন
- সহজে পরিষ্কার করা যায় এমন উপকরণ ব্যবহার করুন
- স্লিপ-রেজিস্ট্যান্ট ফ্লোরিং বা রাগ ব্যবহার করুন
সিনিয়র সদস্য থাকলে:
- আরামদায়ক, সহজে উঠা-বসা করা যায় এমন চেয়ার নির্বাচন করুন
- অতিরিক্ত ভারী ফার্নিচার এড়িয়ে চলুন
- পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করুন
ছোট ঘরের জন্য স্টোরেজ যুক্ত ফার্নিচার বেশ কার্যকর। ডাইনিং টেবিলের নিচে ড্রয়ার বা সিডবোর্ড যুক্ত চেয়ার ব্যবহার করলে অতিরিক্ত জিনিসপত্র রাখা যায়।
যেসব ভুল করা উচিত নয়
ডাইনিং রুম সাজানোর সময় কিছু সাধারণ ভুল এড়িয়ে চলা উচিত:
- আলো কম রাখা: অপর্যাপ্ত আলো ডাইনিং এক্সপেরিয়েন্স নষ্ট করে। পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা করুন।
- টেবিল-চেয়ারের ভারসাম্য না রাখা: টেবিলের আকারের সাথে চেয়ারের সংখ্যা ও সাইজ মানানসই হওয়া উচিত।
- রঙ ও থিমে অমিল: ডাইনিং রুমের রঙ ও থিম বাড়ির বাকি অংশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত।
- খুব বেশি সাজিয়ে জায়গা কমিয়ে ফেলা: অতিরিক্ত আসবাবপত্র ঘরকে ছোট ও চাপা দেখায়। “কম বেশি” নীতি মেনে চলুন।
উপসংহার
ডাইনিং রুম সাজানো একটি ব্যক্তিগত ও সৃজনশীল প্রক্রিয়া। আপনার বাজেট, স্থান এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সবচেয়ে উপযুক্ত আসবাব ও সাজসজ্জা বেছে নিন। মনে রাখবেন, সৌন্দর্য ও ফাংশনালিটি-দু’টোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। আপনার ডাইনিং রুমে পরিবারের সবাই যেন আরামে একসঙ্গে বসে খাওয়া-দাওয়া করতে পারেন, সেদিকে বিশেষ নজর রাখুন।
নিজের রুচি অনুযায়ী সাজিয়ে তোলাই আসল কথা। পরিবারের সদস্যদের পছন্দ-অপছন্দ বিবেচনায় নিয়ে, আপনার বাজেটের মধ্যে থেকেই আপনি একটি সুন্দর ও কার্যকরী ডাইনিং রুম তৈরি করতে পারেন।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
কোন রঙ ডাইনিং রুমে ভালো লাগে?
ডাইনিং রুমের জন্য নিউট্রাল রঙ যেমন বেজ, ক্রিম, হালকা গ্রে অথবা ওয়ার্ম কালার যেমন টেরাকোটা, হলুদ, হালকা লাল ভালো। এসব রঙ খাবারের প্রতি আকর্ষণ বাড়ায় এবং উষ্ণ পরিবেশ তৈরি করে। তবে আপনার ব্যক্তিগত পছন্দ এবং বাড়ির বাকি অংশের থিমের সাথে সামঞ্জস্য রেখে রঙ নির্বাচন করুন।
ডাইনিং রুম সাজানোর খরচ কত পড়ে?
ডাইনিং রুম সাজানোর খরচ বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভর করে। স্বল্প বাজেটে (১০,০০০-৩০,০০০ টাকা) বেসিক সাজসজ্জা করা সম্ভব। মাঝারি বাজেটে (৩০,০০০-৮০,০০০ টাকা) ভালো মানের ডাইনিং সেট ও ডেকোরেশন কেনা যাবে। উচ্চ বাজেটে (১ লাখ+ টাকা) প্রিমিয়াম মানের আসবাব ও ডিজাইনার সাজসজ্জা করা সম্ভব।
আলো বেশি না কম – কোনটা উপযুক্ত?
ডাইনিং রুমে মধ্যম থেকে উজ্জ্বল আলো উপযুক্ত, কারণ খাবার সময় সবাই একে অপরকে ভালোভাবে দেখতে পাবেন এবং খাবারের রং-রূপও স্পষ্ট হবে। তবে ডিমেবল লাইট ব্যবহার করলে বিভিন্ন পরিস্থিতি অনুযায়ী আলোর তীব্রতা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। সন্ধ্যায় রোমান্টিক ডিনারের জন্য হালকা আলো এবং ক্যান্ডেল লাইট ব্যবহার করা যেতে পারে।
আপনার প্রিয় ডাইনিং রুম থিম কোনটি? নিচে কমেন্ট করুন! এই আইডিয়াগুলো বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না!